তনুশ্রী তার বাবার বুকশেলফে হাত রেখে জীবনে প্রথমবারের মত নিজের পায়ে দাঁড়াল।
এক হাত বুকশেলফে রেখে আর অন্য হাত বাতাসে নেড়ে মুখ দিয়ে আনন্দধ্বনি করছে তনুশ্রী। আট মাসের বাচ্চা সে। কথা বলতে পারে না। মুখ দিয়ে কিছু অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করে। তবে শব্দগুলো খুব আদুরে। ও যখন গাগা-গুগু বলে মুখ দিয়ে লালা ঝরাতে ঝরাতে হামাগুড়ি দেয় তখন ইচ্ছে হয় ওর বলা শব্দগুলোকেও আদর করি।
তনুশ্রী খুব খুশি আজ। নিজের গোলগাল দুই পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। তার ছোট্ট গোলমুখের আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে পারলে সে চিৎকার দিয়ে পুরো পৃথিবীকে বলবে - দেখ সবাই, আমি দাঁড়াতে পেরেছি! যেহেতু সে কথা বলতে পারে না তাই আপাতত গাগা-গুগু বলে আনন্দ প্রকাশ করছে।
তনুশ্রীর মা সোফায় হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন আর ভাবছেন বিমল কবে ঘরে ফিরবে। দু'মাস হয়ে গেল যুদ্ধ গেছেন উনি। এখন পর্যন্ত কোনো সংবাদ এলো না। মনে মনে খুব অভিমান করছেন স্বামীর উপর আর বলছেন - অন্তত একটা চিঠি তো লেখতে পারে। কেমন আছে কোথায় আছে কি করছে এগুলি জানিয়ে ছোট্ট একটা চিঠি লেখতে কি সমস্যা তার? এত বিশাল যুদ্ধ করতে পারে আর একটা চিঠি লেখতে পারে না?
কিন্তু তনুশ্রীর মা জয়ীতা দেবী জানেন না যুদ্ধে থাকলে এক বেলা শান্তিমতো বসে ভাত গেলার সুযোগ থাকে না আর চিঠি লেখা তো সেখানে চরম বিলাসিতা!
মেয়ের অর্থহীন কিন্তু আনন্দে ভরপুর গাগা-গুগু শুনে চিন্তায় ছেদ পড়ল জয়ীতা দেবীর। বুকশেলফ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আনন্দে চোখ ভিজে উঠলো তার। খুব ইচ্ছে হলো মেয়ের প্রথম দাঁড়ানোর খবরটা চিঠি লিখে বিমলকে জানাবেন। কিন্তু সে সুযোগ তো নেই! গত দুইমাস ধরে স্বামীর কোনো খোঁজই জানেন না তিনি।
জয়ীতা দেবী সোফা থেকে উঠে রীতিমতো দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হুহু করে কান্না শুরু করলেন। কিন্তু কান্নাটা কিসের তা বুঝা গেল না। মেয়ের প্রথমবার দাঁড়ানোর আনন্দের নাকি বিমল সাহেবকে না জানাতে পারার কষ্টের - বুঝা গেল না!
সেদিন রাতের বেলা মেয়েকে বুকের দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। এরপর ড্রয়ার থেকে সবুজ ডায়েরিটা বের করে লেখতে বসলেন। শেষবার লেখেছিলেন যখন বিমল সাহেব যুদ্ধের জন্য বিদায় নিয়েছিলেন। সে রাতে জয়ীতা দেবী পৃথিবীর সবচেয়ে একা মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন।
ডায়েরির পাতা উল্টে লিখলেন -
১২ নভেম্বর, ১৯৭১
প্রিয় বিমল, আজ আমাদের মেয়ে প্রথমবারের মত নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তাও আবার তোমার বুকশেলফে হাত রেখে। তুমি কবে আসবে বিমল? তনুশ্রী প্রতিদিন দরজার দিকে হাত ইশারা করে কিছু বলার চেষ্টা করে। হয়তোবা বলতে চায় বাবা কবে আসবে। কারণ বাচ্চাটা শেষ তোমাকে দেখেছিল এই দরজা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে। তুমি যুদ্ধ থেকে কবে ফিরবে তা জানি না। আদৌ ফিরবে কিনা তারও ঠিক নেই। বেঁচে আছ নাকি শহীদ হয়েছ, জানি না। জানতেও চাই না। শুধু এই বিশ্বাস নিয়ে দিন পার করি যে তুমি আবার ফিরে আসবে এই দরজা দিয়েই...
২.
শত্রুপক্ষের পাল্টা আক্রমণে সেক্টর ৭-এর মূল ঘাঁটির পশ্চিমদিকে অংশটা ধ্বংস হয়ে গেছে। একজন মুক্তিবাহিনী শহীদ হয়েছেন আর তিনজন মারাত্মক জখম। কিন্তু বিপরীতে শত্রুপক্ষের নিহত হয়েছে নয়জন আর জখম হয়েছে বারোজনের মত।
বিমল সাহেব সেক্টর ১২'র ক্যাপ্টেন। ওনার নির্দেশনায় এই সেক্টরের প্রায় সবগুলো গ্রাম শত্রুমুক্ত হয়েছে। বাকি ছিল কেবল এই নওয়াব পাড়াটা। আজকে এই পাড়াকে শত্রুমুক্ত করার প্রতিজ্ঞায় মাঠে নেমেছেন ১২ নাম্বার সেক্টরের ১৭ জন মুক্তিবাহিনী।
তুমুল যুদ্ধ চলছে। শত্রুপক্ষের অস্ত্রশস্ত্র প্রচুর। তবুও তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। ক্যাপ্টেন বিমল আগে থেকেই জানতেন শত্রুপক্ষ কোনদিক থেকে আসবেন। তাই তিনি দলের তিনজনকে বলে আগের রাতে ব্রীজের নীচে ডায়নামাইট ফীট করে রেখেছিলেন। আর সেখানেই শত্রুপক্ষের মূল অস্ত্র ট্যাংক পাঁচ সেকেন্ডেই কুপোকাত।
শত্রুপক্ষের প্রায় বত্রিশজন নিহত হয়েছে। বাকি আছে সাত আটজনের মত। এদের কপালের ঠিক মাঝে গুলি করার জন্য ক্যাপ্টেন বিমল নির্দেশ দিলেন আহসানকে। তিনি ভাল করেই জানেন আহসানের টিপ একদম নির্ভুল। গত সাতটি মিশনে একবারও লক্ষ্যচ্যুত হয়নি তার কোনো টিপ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শত্রুপক্ষের মেশিনগানটি। বেশ শক্তিশালী ধরণের এক পাকসেনা মেশিন গানটি কন্ট্রোল করছে। তার দিকে গুলি মারা অসম্ভব। সামনে বেশ শক্তিশালী ব্যারিকেড দেয়া। মূল ঘাঁটি থেকে একটু হেঁটে ওদিকটায় গিয়ে গ্রেনেড মেরে মেশিনগান সহ চালককে ধ্বংস করা যাবে। নয়তো এই মেশিনগানের কারণে তার পুরো দলকে শহীদ হতে হবে। এখন একমাত্র উপায় গ্রেনেড মেরে মেশিনগান ধ্বংস করে ফেলা।
কিন্তু গ্রেনেড নিক্ষেপের দায়িত্ব কাকে দিবেন তিনি? আর ওদিকে যাওয়াটাও বেশ রিস্কের ব্যাপার। দলের কাউকে এমন রিস্কে ফেলতে চাচ্ছেন না। তিনি ঠিক করলেন নিজেই যাবেন। সময় নষ্ট না করে একটি গ্রেনেড হাতে নিয়ে মূল ঘাঁটির পাশ কাটিয়ে কৌশলে দৌড় দিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই বুলেট এসে লাগল তাঁর কোমরে। দ্বিতীয় বুলেট লাগল তার বুকের ঠিক মাঝে। তবুও তিনি দৌড়ানো থামালেন না। আর কয়েক কদম আগালেই গাছের আড়ালে চলে যেতে পারবেন উনি। সেখান থেকে খুব সহজেই গ্রেনেডটিকে মেশিনগানের দিকে নিক্ষেপ করা যাবে। এমন সময়ে একটা বুলেট এসে লাগল তাঁর ডান হাঁটুতে। মুহুর্তে পড়ে গেলেন মাটিতে।
ক্যাপ্টেন বিমলের দেহ থেকে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। তিনি মূল ঘাঁটির দিকে তাকালেন। দেখলেন মেশিনগানের গুলিতে তার দলের সঙ্গীদের দেহ মুহুর্তের মধ্যে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পায়ে জোর পেলেন না। অবশেষে তিনি হামাগুড়ি দিয়ে বটগাছটার আড়াল হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এখনই যদি গ্রেনেডটি মেশিনগানের দিকে নিক্ষেপ না করেন তাহলে মুহুর্তের মধ্যেই তার দলকে হার মানতে হবে পাকবাহিনীর কাছে।
ক্যাপ্টেন বিমল গাছে হেলান দিয়ে একমুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলেন। বুকপকেটে রাখা চিঠিটা বের করলেন। পুরো চিঠি রক্তে ভেজা। শুধু বোঝা যাচ্ছে একটা লাইন - "প্রিয় জয়ীতা, এখনো বেঁচে আছি। তনুশ্রীর কথা খুব ম" - এরপর লাল রক্তে কালো কালি ঢেকে গেছে।
বিমল সাহেব এক হাতের মুঠিতে চিঠি আর অন্য হাতে গ্রেনেড নিয়ে ভাবছেন - যুদ্ধ শেষ হলে বাড়ি ফিরে যাবেন। জয়ীতাকে জড়িয়ে কপালে চুমু খাবেন। মেয়ের সামনে দুইহাত মেলে ধরবেন আর মেয়ে খুশিতে হেলেদুলে বাবার কোলের দিকে ধীরে ধীরে কদম বাড়াবে।
পরিবার নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে ক্যাপ্টেন বিমলের মনে হলো - বিচিত্র সুন্দর এই বেঁচে থাকা! কিন্তু তিনি তো মারা যেতে পারেন এই যুদ্ধে! তাহলে? তার কারণে যদি দেশটা স্বাধীন হয় তবে সেখানে আরও লাখ লাখ মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে। ওরাও একদিন স্বাধীন রাষ্ট্রে বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে তার মতই বলবে - আহা, বিচিত্র সুন্দর এই বেঁচে থাকা!
আর দেরি করলেন না তিনি। ক্যাপ্টেন বিমল বটগাছে এক হাত রেখে জীবনের শেষবারের মত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য হাতটা তুমুল বেগে ঘুরিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে মারলেন মেশিনগানটির দিকে...