শব্দের ছবি [শৈশবের গল্প]
শীর্ষেন্দুর গল্পসমগ্র পড়তে পড়তে ছোটকালের একটা বিচ্ছিন্ন সুখস্মৃতি মনে
পড়ে গেল। সময়টা ছিল ২০০২ কিংবা ২০০৪ এর মাঝামাঝি সময়ের। তখন শুধু বই ধরতে জানতাম, পাতা
ওলটাতে জানতাম, বইয়ের ছবি দেখে কল্পনা করতে জানতাম, কিন্তু পড়তে জানতাম না। বানান করতে
পারতাম কয়েকটা শব্দ। কঠিন বানানগুলি একবার জেনে নিলে পরের বার থেকে সেই বানানের চেহারা
বা ছবি দেখলে বানান না করেই বুঝতে পারতাম শব্দটা আসলে কি।
ছোটকালে দেখেছিলাম মা প্রচুর বই পড়তেন। আমাকে ইংরেজি এলফাবেট দিয়ে শব্দ গঠন
করতে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে মোটা মোটা উপন্যাস পড়তেন। তখন মাকে দেখে পৃথিবীর সবচেয়ে
সুখী মানুষ মনে হত।
এখন আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পসমগ্র পড়ছি। মায়ের প্রিয় লেখক ইনি।
ছোটকালে মা আমাকে লেখকদের নাম বানান করে শিখিয়েছিলেন। কারণ এই নামগুলি চার/পাঁচ বছরের
বাচ্চার জন্য কিছুটা কঠিন। যেমন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়,
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ !
মা আমাকে বানান করে শিখিয়ে দিতেন কোন লেখকের নামের উচ্চারণ কি হবে। উচ্চারণ
করতে পারতাম ঠিকই। কিন্তু বানান করতে কষ্ট হত। তাই আমি একটু বুদ্ধি খাটাতাম। লেখকের
কঠিন নামটার বানানকে ছবি হিসেবে মনে রাখতাম। এরপরের থেকে সেই ছবি [কঠিন বানানের নাম]
দেখলে আপনাআপনি উচ্চারণটা চলে আসত জিহ্বার ডগায়।
সহজ করে বলতে গেলে আমি কঠিন বানানগুলিকে ছবি হিসেবে মনে রাখতাম।
মা আমাকে আদেশ দিতেন – বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসসমগ্রটা এনে দাও তো
বুকশেলফ থেকে।
তখন আমি কিভাবে মায়ের কাঙ্ক্ষিত বইটা খুঁজে বের করতাম বুকশেলফের হাজার বই
থেকে, জানেন ? মা যে নামটা বলেছেন তার উচ্চারণটা মনে রাখতাম আর তার সাথে যে ছবির[কঠিন
বানান] অবয়ব মিলে যায় সেটা মনে করার চেষ্টা করতাম। এরপর বুকশেলফে গিয়ে খুঁজতাম যে সেই
ছবিটাকে[কঠিন বানানটাকে] বইয়ের মলাটে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েও যেতাম মায়ের সেই
কাঙ্ক্ষিত বইটা। এরপর ছোট হাতে বটা বইটা নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিতাম।
মায়ের হাত বলতেই মনে হল উনি কি তখন চুড়ি পড়তেন হাতে ?
একবার মনে হচ্ছে চুড়ি পড়তেন আরেকবার মনে হচ্ছে ব্রেসলেট জাতীয় কিছু ঝুলত
মায়ের কোমল হাতে। জিজ্ঞেস করতে হবে মাকে।
এখন আমি ২১ বছরের একজন যুবক। কথাটা
বলতে হাস্যকর লাগলেও বলতে হয় যে আমি সব কঠিন শব্দের বানান করতে পারি। তবে আমার সেই
ছোটকালের লেখকদের নাম এখনও ছবি হিসেবেই মনে রাখি।
