ওড়নায় শেষ গিট্টু
এই
যে, আমার সাথেই পড়ত মেয়েটা ! ক্লাসে আসত, দুষ্টামি করত, আনন্দে লাফাত, নামটাও সুন্দর 'ঐন্দ্রিলা' !
লাইব্রেরী
থেকে বই নিয়ে ফেরত
দেয়ার কথা ভুলে যেত সে ! হঠাৎ করে একদিন মনে পড়ত, 'আরেহ, বইটা তো ফেরত দিতে
হবে !' তখন ফেরত দিতে যেয়ে দেখা যেত জরিমানা যত টাকা আসছে
তত টাকা দিয়ে সেই বই'ই তিন/চারটা কিনে ফেলা যাবে !
আরে
হ্যাঁ, সত্যি বলছি ! সেদিনই তো ও আমার
সামনে খিলখিল করে হাসতে হাসতে প্রায় সাড়ে তিনশ টাকা জরিমানা দিয়ে ম্যাথ বইটা ফেরত দিল ! [পরে আমরা জানতে পারলাম বাজারে বইটার এক কপির দাম
১৩০ করে, লোকাল প্রিন্টের]
.২.
স্ট্যানলি
স্যারের ম্যাথ নিয়ে আমাদেরকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ! কোন ম্যাথ স্যার বেশি পছন্দ করে, কোন ম্যাথের চেহারা দেখলে মন হয় 'আমি
আসব এক্সামে, আমাকে পড়, সমাধান কর' বলে হাহাকার করছে ! আবার এমনও হয় পরীক্ষার আগের
রাতে - সব শেষ করে
বিছানায় চলে গেছি, ঘুমানোর আগে যে কয়টা ম্যাথ
আমরা করি নাই সেগুলাই আসবে পরীক্ষায় এই ভেবে শোয়া
থেকে উঠে মশারির ভেতর ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ম্যাথ করতে বসে গেছি !
হ্যাঁ
হ্যাঁ, এত পরিশ্রমের পর
কমন পড়ত বটে ! গর্বের সাথে পাশ করে পরের সেমিস্টারে এক লাফে উঠে
যেতাম !
২য়
সেমিস্টারের ম্যাথ এক্সামের গল্প বলি একটা !
পরীক্ষার
আগের দিন, ম্যাথ করি, ম্যাথ বুঝি !
আবার
ম্যাথ করি, কিন্তু বুঝি না ! - এমন করেই চলছে আমার ম্যাথ করা ! হঠাৎ করেই ঐন্দ্রিলা ফোন দিয়ে কয়েকটা ম্যাথ আর থিওরির নাম
বলে জিজ্ঞেস করল, 'সৃষ্টি, এই ম্যাথগুলা সমাধান
করেছ ? পার করতে ? মেসেঞ্জারে খাতার ছবি দিয়েছি তোমাকে, দেখ তো, পার কিনা !'
ম্যাথগুলা
দেখলাম, চিনলাম না ! নতুন নতুন লাগছিল ! কয়েক সেকেন্ড গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকায় থাকার পর মনে পড়ল,
এই ম্যাথ তো স্যার দিয়েছিল
আমরা যেন নিজে করি, কিন্তু করা হয়নি । অলসতার কারণে
এলোমেলো টেবিলের এক কোণে ধুলোর
নীচে গভীর নিদ্রায় শায়িত ছিল এতদিন ! অবশেষে পরীক্ষার আগের রাতে ঐন্দ্রিলার কারণে নিদ্রা ভাঙে সেই ম্যাথগুলির !
তো
যাইহোক, বললাম - আরে না, করি নাই ! তুমি করলে আমাকে দাও ।
ঐন্দ্রিলা
বলল, আমিও করি নাই ! চল, মিলেমিশে করি ! আমরা একসাথে চেষ্টা করলে পারব !
বললাম,
আচ্ছা ঠিকাছে !
এই
বলে আমরা মিলেমিশে ওই ৪ টা
ম্যাথ সমাধান করলাম রাত দেড়টা পর্যন্ত !
পরের
দিন সকালে বিছানা থেকে উঠে দৌড় দিয়ে এক্সাম হলে গেলাম, কাঁপা কাঁপা হাতে খাতা আর প্রশ্ন নিলাম
! আরেহ, সেই চারটাই ! ঐন্দ্রিলার সাথে আমার চোখাচুখি হল ! দুজনই বুঝলাম, দুজনই খুশি !
শাদা
খাতার উপর খশখশ করে কলম চালিয়ে লেখে দিলাম সেগুলি !
পরীক্ষা
শেষ, ঐন্দ্রিলার সাথে সাক্ষাৎ হল ! বললাম, গতকাল শেষ সময়ে ওই চারটা ম্যাথ
না করলে আজকে পাশই হত না !
ও
বলল একই কথা ! ওর'ও নাকি
পাশ হত না !
.৩.
ভার্সিটির
রেজাল্ট বের হল হঠাৎ করেই,
কাউকে না বলেই !
দুইজনেই
পাশ করলাম গর্বের সাথে !
এই
খুশিতে ঐন্দ্রিলা আমার থেকে মোটাসোটা দুটা বার্গার চেয়ে বসল, খাবে বলে ! পকেটে টাকা ছিল না, তাই বললাম - আচ্ছা, ঠিকাছে, টাকা হোক, খাওয়াবো !
বলল,
আচ্ছা, ঠিকাছে, মনে থাকে যেন !
.৪.
ঐন্দ্রিলা
একবার আমাকে বলেছিল, ‘সৃষ্টি, আমাকে একটু প্রোগ্রামিংটা দেখাইও তো, কিছু বুঝি না কি করতে
হবে !’
বললাম,
আচ্ছা, ঠিকাছে ! খাতা-কলম নিয়ে কম্পিউটার ল্যাবে আমার সাথে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য বসিও, প্রোগ্রামিং-এর সব রাস্তাঘাট
বুঝিয়ে দেব !
ও
মজা করে বলল, ‘প্রোগ্রামিং-এর রাস্তাঘাট শহরের
রাস্তা নাকি গ্রামের মেঠোপথ ?’
আমি
বললাম, উভয়ই !
ঐন্দ্রিলা
বলল, আচ্ছা, যদি প্রোগ্রামিং-এর রাস্তা গ্রামের
হয়ে থাকে তাহলে একটু ভাল করে বুঝায় দিও, যেন বর্ষার সময় পিছলে পড়ে গায়ে কাদামাটি না ভরাই !
এই
কথা শুনে আমি দাঁত বের করে হাসা শুরু করলাম ! প্রোগ্রামিং এর মত একটা
কাটখোট্টা জিনিসকে এতটা কাব্যিক বানায় দিল মেয়েটা !
.৫.
এরপর
বেশ অনেক দিন কাটল, অনেক কিছু হল ! অনেক পরীক্ষা-এসাইন্ম্যান্ট-কুইজ-ক্লাস্টেস্ট-ল্যাবট্যস্ট-ফাইনাল দিলাম ! আমরা ভার্সিটি আসলাম গেলাম ! জুনিয়র ব্যাচের একজন পানিতে ডুবে মারা গেল, সাথে সিনিয়র ব্যাচের সবচেয়ে হাসিখুশি ভাইয়াটাও ডুবল, ক্লাসের অন্য একজন মিনি বাসের ধাক্কায় মেরুদণ্ড ভাঙল, বিবাহিত ক্লাসমেটের
মেয়ে বাচ্চা হল, আমি ওর নাম রাখলাম
'নিধি' ।
মাঝে
আবার স্ট্যানলি স্যারের ম্যাথ খাতা ফটোকপি করা নিয়ে ঐন্দ্রিলা আমার উপর কেন যেন অনেক রাগ করল, এতটাই রাগ যে আমাকে অনেকগুলা
বকা দিয়ে ফেসবুক থেকেই ব্লক, ক্লাসের কথা বলে না ! সেই এক্সামের সময় ওর সাথে আর
একসাথে ম্যাথ করা হয়নি, তাই আমি জানিও না যে ওর
কতটুকু কমন পড়েছিল, পরে রেজাল্টের সময় জানতে পারলাম পাশ করেছিল !
আরও
অনেক কিছুই হল, সেগুলি নিয়ে বলতে গেলে একটা পেটমোটা উপন্যাস হয়ে যাবে !
ঐন্দ্রিলা
চঞ্চল থেকে শান্ত হয়ে গেল আমাদেরকে কিছু না বলেই ! ক্লাসে
আসত বেশ শান্তভাবে, ক্লাস করত, চলে যেত কাউকে কিছু না বলেই ! আমরা
জানতেও পারলাম না কি চলছে
ওর মধ্যে ! তবে ওর শান্ত হয়ে
যাওয়া দেখে আমার কেমন যেন লাগল, মনে হচ্ছিল কিছু একটা হবে যা কখনোই হয়
নি আর তা হবে
শেষবারের জন্যে ! কি হবে জানতাম
না, তবে আমার ইনটুইশন বলছিল, ভয়ংকর কিছু একটা হবে ! আমি নিজেও ওর শান্ত হওয়া
দেখে ভয় পাচ্ছিলাম ! এত
চঞ্চল আর প্রজাপতির মত
লাফিয়ে বেড়ানো একটা মেয়ে কিভাবে এতটা শান্ত হতে পারে ?!
ঝড়
আসার পূর্বে চারদিক শান্ত হয়ে যায় !
আমাদের
ঐন্দ্রিলাও শান্ত হয়েছিল, ফ্যানের সাথে ওড়নায় শেষ গিট্টু দেয়ার আগে !