গাদ্দার
যেহেতু মায়ের
বাড়িতে আছি তাই মায়ের বইয়ের বিশাল সাগরে বইপত্র ঘেঁটে এবং পড়ে সময় কাটে ।
ঈদের দিন
পড়ে শেষ করেছিলাম সুনীলের লিখা ‘অরণ্যের দিনিরাত্রি’, অরণ্য নিয়ে লিখা দারুণ একটি বই,
প্রেম প্রেম ভাব আছে, বন্ধুত্বের ঘটনাও চোখে পড়ার মত !
ঈদের ২য় দিন
মায়ের বইয়ের সাগরে নতুন বই খুঁজছিলাম পড়ার জন্যে ! অনেকক্ষণ ধরে বইপত্র নাড়াচাড়া করছিলাম
– উত্তরাধিকার, পার্থিব, দূরবীন, চক্র, আরও কত মোটা মোটা বই ! বলা বাহুল্য – এত নাদুসনুদুস
বই লিখায় বিশাল ধৈর্যের প্রয়োজন !
মা বললেন,
‘দেখি, কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’ পড়, নতুন লেখকের বই পড় !’
দুপুর গড়িয়ে
সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ৮৫ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে ফেললাম !
বইটা উর্দু
থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন আনোয়ারা বেগম ! যদিও অনুবাদ করা বই পড়া নিয়ে আমার খুব বাজে
অভিজ্ঞতা ছিল, ওগুলি পড়লে মনে হয় - ক্লাস থ্রীর বাচ্চাকে দিয়ে ট্রান্সলেশন করানো হয়েছে
! কিন্তু আনোয়ারা বেগমের অনুবাদ পড়ে মনে হল এটি তার নিজেরই লিখা, কারণ অনুবাদ স্বাবলীল
ও স্বচ্ছন্দ !
বইটি ভাল
লাগার কারণ – গ্রন্থের বক্তব্য, লেখকের পরিবেশন কুশলতা, ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্রচিত্রণের
সহজাত শক্তি ! ঘটনাগুলি বেশ গতিশীল !
বইটির ছোট
একটি অংশ এখানে তুলে ধরছি যা পড়ে আমার চোখে অশ্রু আসতে দ্বিধা করেনি –
“মুসলমানদের
একটি দল এখান দিয়ে চলে গেছে । কিছু লোক তখনও সেখানে ছিল । সড়ক থেকে নীচের মাটিতে তারা
কবর খুঁড়ছিল । কাছেই পড়েছিল একটি দেহাতী মুসলমানের মৃতদেহ । কাপড় আবৃত সেই দেহের মাথা
নেই, তাও বোঝা গেল । রাস্তার ওপরে বসে এক বৃদ্ধ মুসলমান একটা মাথা দুই হাতের মধ্যে
নিয়ে হাহাকার করে কাঁদছে । বারবার চোখের পানি মুছছে – হাতের মধ্যে রাখা মাথাটিকে দেখছে,
চুমু খাচ্ছে আর বলছে – “আমার ছেলে – আমার ছেলে” – আশেপাশের সকলে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে
! বৃদ্ধ মাথাটিকে লাশের কাছে এনে হাঁটু গেড়ে বসল । ধড়ের সাথে মাথাটিকে লাগানোর ব্যর্থ
প্রয়াস করতে লাগল । তাঁর হাত কাপছিল । আস্তে আস্তে ভাঙ্গা গলায় সে বলল – “আমার ছেলে
– আমার ছেলে ।” সকলে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে । “আমার এই একটিমাত্র ছেলে ছিল – একটিমাত্র…”
গর্ত খোঁড়া চলতে থাকল, গর্ত ক্রমশ গভীর হতে থাকল । বৃদ্ধ শেষবারের মত ছেলের কপালে চুমু
খেল । ছেলেটির কাল চুল ভরা মাথা – কোঁকড়ানো চুল এসে কপালে পড়েছে । পাতলা সুন্দর দুটি
ঠোঁট । তাঁর শায়িত নিষ্প্রাণ মুখটি তক্ষশীলার যাদুঘরে রক্ষিত বুদ্ধমূর্তির মত দেখাচ্ছিল
।
কবর খোঁড়া
হয়ে গেল । দূর থেকে ‘সৎশ্রী আকাল আর হর হর মহাদেও’ ধ্বনি ভেসে এল । খননকারীরা তাড়াতাড়ি
করে কবরের মধ্যে লাশ রেখে মাটি চাপা দিতে শুরু করল । বৃদ্ধ প্রথমদিকে ওদের বাঁধা দেয়ার
চেষ্টা করছিল । কয়েকজন তাকে জোর করে সরিয়ে নিলে সে অবসন্নের মত বসে মোনাজাত করার জন্য
দুহাত তুলল । দুরাগত ধ্বিনি কানে আসতে লাগল । “সৎশ্রী আকাল হর হর মহাদেও ।” যতদ্রুত
সম্ভব ততখানি দ্রুততার সঙ্গে কবর মাটি দিয়ে ভোরে দেয়া হল, তারপর তারা পালাতে আরম্ভ
করল । কেবল সেই বৃদ্ধ কবরের পাশে বসে সূরা ফাতেহা পড়তে লাগল । “সকল প্রশংসা তোমারই
জন্য আল্লাহ । পরওয়াদিগার, সারা জাহানের মালিক, বখশিশ করনেওয়ালা, রুজি রোজগারের মালিক,
তোরই ইবাদাত করছি, তোর কাছে সাহায্য চাইছি, আমাকে পথ দেখিয়ে দে – সোজা পথ । যে পথে
তোর প্রিয়জনরা গেছে, সে পথ আমাকেও দেখিয়ে দে । গজব আর ভুলে ভরা পথ থেকে আমাকে সরিয়ে
রাখ । আলহামদো লিল্লাহি রাব্বিল আল-আমীন ।“
“সৎশ্রী আকাল
হরহর মহাদেও” --- বাতাসে বল্লম ঝলসে উঠল আর প্রার্থনারত বৃদ্ধ মুসলমানের দেহ চার টুকরো
হয়ে পড়ে গেল ।
মৃত্যুপথযাত্রীর
মুঝ থেকে শেষ যে নাম উচ্চারিত হয়েছিল তা ঈশ্বরের । হত্যাকারীর মুখেও ছিল তারই নাম ।“
![]() |
গাদ্দার (১৯৭৮ সালের কপি)
|