সেদিনের বইগুলি আর সৌন্দর্য
তো আজ সকালে হয়েছিল কি জান ? জান তো না !
আমি বলি, তোমরা শোন তাহলে ! শুনবে তো ?
-১-
সকাল বেলা যখন আমার বই-এর তাকের দিকে তাকালাম, তখন দেখলাম যে, ১ম সেমিস্টারের প্রোগ্রামিং – ম্যাথ – ক্যালকুলাস – ফিজিক্স এর মোটাসোটা বইগুলি কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! ওদের কটমট চাহনি দেখেই আমার সকাল বেলার মগজটা কেমন যেন আমতা আমতা করা শুরু করল !
ভাবলাম, এগুলির জায়গায় রবীন্দ্র-সুনীল-সমরেশ-হর্ষ দত্ত-জাহানারা-মার্সেল মোরিং বা ম্যুরের বইগুলি দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে কেমন হয় ? আর এমনিতেও এই কটমটে-নিরস বইগুলি আর প্রয়োজনও নেই বৈকি !
অতএব, সবকটি বই-এর ঘাড় ধরে ব্যাগে পুরে নিলাম আর রওনা দিলাম নীলক্ষেত এর উদ্দেশ্যে !
-২-
আমার বাহন ছিল “বাস” ! আর এটা যেহেতু যাদুর শহর ঢাকা তাই এখানে রাস্তায় বাহনগুলি কচ্ছপের গতিতে দৌড়োয় ! অবশ্য আমি এই ধীর গতিকে আনন্দের করতে সাথে নিয়েছিলাম সুনীলের “ভোরবেলা পার্কে” !
এই বইটি দারুণ বটে ! কারণ রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের যদি দশখানি বই-এর নাম করতে হয়, যা অভিনবত্বে স্বতন্ত্র – হৃদয়মন-চোয়ানো আলোয় প্রজ্জ্বল, তাহলে সুনীলের “ভোরবেলা পার্কে” অনিবার্যভাবে উচ্চার্য !
-৩-
আজকের বাহনগুলি কচ্ছপের থেকেও দারুণ ধীর গতিতে চলছিল ! তাই বাসের ভেতর ঠেস মেরে বসে থাকা অবস্থাতেই সুনীলের বইটি শেষ করলাম !
-৪-
ভাগ্য ভাল বলে বই শেষ করা মাত্রই গৌন্তব্যে পৌঁছে গেলাম !
তারপর একটা পুরাতন বইয়ের দোকানে আমার সেই কটমটে-নিরস বইগুলিকে ঘাড় ধরে ছেড়ে দিলাম ! আর প্যান্টের পকেটে গুঁজে নিলাম চারশ টাকা !
-৫-
আহ ! বাঁচা গেল অবশেষে সেই নিরস বইগুলি থেকে !
এরপর দৌড় দিলাম রসাল দারুণ সব বই কিনতে !
এক এক করে কিনে ফেললাম এগুলি –
রবীন্দ্রের শেষের কবিতা,
নীললোহিতের হঠাৎ দেখা,
সুনীলের - অরণ্যের দিনরাত্রি, হীরকদীপ্তি, দুই বসন্ত, মালার তিনটি ফুল,
শীর্ষেন্দুর বৃষ্টির ঘ্রাণ,
সমরেশের মেয়েরা যেমন হয়,
জাহানারা ইমামের জীবন মৃত্যু,
মার্সেল মোরিং-এর দা গ্রেট লঙিং,
হর্ষ দত্তের রাজকন্যা রাজকন্যা,
আর ম্যুরের নীতিতত্ত্ব !
বলা দরকার,
নীললোহিত হচ্ছে সুনীলের ছদ্মনাম !
ছবিগুলি রমনার লেকে তোলা !
-৬-
ওহ ! বলাই তো হয়নি, আমার সাথে ছিল প্রকৃতিপ্রেমী মিরাজ, সে ও অবশ্য প্রচুর পড়ে, আর তাই সে কিনেছিল সমরেশের সাতকাহন [১ম + ২য় খন্ড] !
যেহেতু এই বইটি আমি পড়িনি, সেহেতু কোন উক্তি করতে পারলাম না, মিরাজ পড়া শুরু করে দিয়েছে মনে হয় ! ওকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে !
-৭-
ব্যাগভর্তি করে রসাল বইগুলি নিয়ে আবারও হাঁটা দিলাম, মিরাজ হুট করেই বলে বসল যে, “চল, রমনা যাই ! ওখানের পরিবেশটা দারুণ !”
-৮-
তারপর চলে গেলাম রমনায়, ব্যাগভর্তি গল্পের বইসহ !
আমিও জানতাম রমনা যে কতটা দারুণ !
আমার মনে হয় ঢাকার অনেকেই জানে না যে এই কাটখোট্টা শহরে এত সবুজ আর শান্তির একটি জায়গা আছে ! তুলনা করতে গেলে বলা যায়, সাহারা মরুভূমির ঠিক কেন্দ্রে এক গ্লাস শীতল লেবুর শরবত !
এই রমনায় কাঠবিড়াল আছে, অনেক আগে বাচ্চারা ওদের বাবার সাথে রমনায় যেত প্রায় শুক্রবার বা ছুটির দিন গুলোয় ! সেই এক একটা দিন ছিল ওদের জন্য ঈদ এর মত ! বাচ্চাগুলি কাঠবিড়ালি দেখা মাত্রই ওদের পিছে ছোটা শুরু করত ! নাগাল তো পেতই না, উল্টো কাঠবিড়ালিগুলি গাছের আড়ালে চলে যেত ! আর দেখা পাওয়া যেত না !
রমনায় বিশাল একটি লেক আছে যার শান্ত জলে পা ডুবিয়ে নাম না জানা উড়ে যাওয়া পাখির ডাক শোনা যায় !
স্থির পাখির আওয়াজ থেকে উড়ে যাওয়া পাখির আওয়াজ মনের মধ্যে বেশি চঞ্চলতা সৃষ্টি করে !
রমনার লেকটিতে আগে অনেক নৌকা সাঁতার কেটে বেড়াত, কিন্তু এখন নেই ! লেকের অনেক অংশ ভরাট হয়ে গেছে !
রমনায় এক ধরণের গাছ আছে যাতে উজ্জ্বল হলুদ রং-এর ফুল ফোটে আর পুরোটা সময় এর তলায় হলুদ ফুল ঝরে পড়তে থাকে ! এক মুহুর্তের জন্য দেখলে মনে হবে গাছতলায় কেউ নিজের হাতে বোনা হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে !
এখানের ফুলগাছগুলিতে
এত বেশি ফুল ধরে যে ফুলের ভারে গাছের বিশাল ডাল ঘাসের ওপর নুইয়ে পড়ে ! আর তখন মনে হয়
যে লাল-হলুদ-নীল ফুলগুলি সবুজ ঘাস থেকে ফুটে আছে !
রমনার পরিবেশটা অনেক শান্ত, কেউ চাইলে এখানে এসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে সবুজ ঘাসের ওপর ! জম্পেশ একটা ঘুম হবে ! সবরকম দুশ্চিন্তা কেটে যাবে !
রমনায় আরও অনেক কিছুই আছে যেগুলি কিনা “বোধ” ! আর আমার মত কোন অধমের পক্ষে “বোধ” কে ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব না !
৯-
রমনায় প্রায় ৩/৪ ঘণ্টার মত ছিলাম !
শুরুতে লেকের পানিতে ঠ্যাং চারটি ডুবিয়ে বসে ছিলাম আমি আর মিরাজ, মাঝে মধ্যে হাত দিয়ে পানির মধ্যে আলোড়ন বানিয়ে দিচ্ছিলাম ! অনেক অনেক ছবি তোলা হয়েছিল এ নিয়ে !
অল্প সময়ে অধিক ছবি তোলার কারণে আমার নীল ফোনটি প্রায় আগ্নেয়গিরির লাভায় পরিণত হয়েছিল !
মিরাজ দারুণ একটি ভিডিও বানিয়েছিল বাতাসের কারণে পানির শান্ত স্রোত নিয়ে ! পরে ভিডিওটি দেখে বোধ হল - ছেলেটার হাত ভিডিও করার জন্য যথেষ্ট স্ট্যাবল !
-১০-
লেক থেকে বিদায় নিয়ে এলোমেলো হয়ে এদিক-সেদিক হাঁটা শুরু করলাম ! যা ভাল লাগছিল চোখে তারই ছবি তুলছিলাম পাগলের মত !
হঠাৎ করেই একটি কিশোর বয়সী কুকুরকে দেখতে পেলাম ! মৃন্ময় কুকুর খুউব পছন্দ করে ! তাই কুকুর দেখলেই মনে হয় যে ওর জন্য কুকুরের ছবিই তুলে নিয়ে যাই ! তাই এবারও কুকুরের ছবি তোলা শুরু করে দিলাম ! কুকুরটিও ছিল বেশ বুদ্ধিমান কারণ ক্যামেরা দেখামাত্রই লম্বা গোলাপি জিহ্বা বের করে দারুণ সব পোজ দিতে লাগল ! বেশ সুবিধেই হল আমার জন্যে !
পছন্দমত ছবি তোলা শেষ করে কুকুরটির ঘাড়ে আদর করে দিয়ে অন্য দিকে চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে আমার পিছু নিল, তারপর আমার পা শোঁকা ! বুঝে গেলাম, এর সাথে আমার একটি সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে, এই যাত্রায় সে আর আমাকে ছাড়বার পাত্র নয় !
-১১-
বেশ লম্বা সময় ধরে কিশোর কুকুরটি সাথে ঘুরে বেড়ালাম এখানে-সেখানে !
যখন আমি, মিরাজ আর ও তিনজনেই ক্লান্ত, তখন সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়লাম ! বিশ্রাম নিতে চাই কিছুটা !
ভাবলাম, খোলা আকাশের নীচে বসে কিছুটা সময় কাটান যাক কেবলই কেনা বইগুলিতে চোখ বুলিয়ে ! তাই ব্যাগের ভেতর থেকে সবকটা বই ঘাড় ধরে বের করে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিলাম !
একে একে বইগুলি দেখতে থাকলাম, কিছু কিছু বইয়ে উপহার বার্তা লিখা আছে, সেগুলি অনেক পুরনো ! ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ! বার্তাগুলিতে উপহার দাতার সরল-স্বাভাবিক-নির্ভেজাল ভাব প্রকাশ পেয়েছে !
আমি নিজে বইগুলি পড়ার পাশাপাশি কিশোর কুকুরটিকেও কিছু বই পড়তে দিচ্ছিলাম ! দেখলাম যে, ও খুব দ্রুত বই পড়তে পারে আর পড়া শেষ করা মাত্রই বইয়ে একটা কামড় দেয় ! আমি অবশ্য সাথে সাথে ঐ বইটি পাল্টে নতুন একটি বই তার সামনে মেলে ধরি !
সে বই পড়ার মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে গোলাপি জিহ্বা বের করে জানান দিচ্ছিল, বইটি তার ভাল লেগেছে !
এভাবে করে বেশ খানিকক্ষণ আমাদের বই পড়া চলল !
তারপর আবার হাঁটা দিলাম আমরা তিনজন !
১২-
আমরা হেঁটেই চলেছি রমনার শান্ত পরিবেশে !
হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম, নীল আকাশের সাদা মেঘগুলি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে, একে একে সব মেঘ রাগে ফুলে উঠছে, ফলে সূর্যের আলো আসতে বাঁধা পাচ্ছে রমনায়, মাঝে মধ্যে তারা চিৎকার করছে গুড়গুড় করে ! তাদের চিৎকারে আমাদের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা ! আর এই চিৎকারের কারণে আমরা এই শান্ত সবুজ রমনাকে এক মুহুর্তের জন্য অতিরিক্ত আলোকিত হতে দেখছিলাম !
মাঝে মধ্যে মেঘগুলির চিৎকারের জোর এতই বেশি ছিল যে আমাদের হৃদপিণ্ড ভয় পেয়ে যাচ্ছিল ! কিছু কিছু মেঘ আবার ঝগড়া করে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল !
-১৩-
মেঘগুলির চিৎকার ও কান্না, এই দু মিলিয়ে এক ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল !
তাই নিরাপদ জায়গা খুঁজে বের করার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিলাম, কিন্তু পাচ্ছিলাম না !
হঠাৎ চোখ গেল একটি বড় গাছের নীচে, দেখলাম একটি বেঞ্চের পাশে কিশোর কুকুরটি বসে গোলাপি জিহ্বা বের করে আমাদের অপেক্ষা করছে !
গিয়ে বসলাম সেখানে, অবশেষে, আমাদের একটি আশ্রয় হল !
-১৪-
যখন মেঘের ঝগড়া আর কান্না মোটামুটি থেমে যায়,
তখন আমরা বেরিয়ে পড়ি,
তখন কিশোর কুকুরটির চোখ বেয়ে মেঘ গলে গলে পড়ছিল !